কিস্তি নির্ধারণের পদ্ধতি বা উপায়সমূহ – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “বীমা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা” বিষয়ের ” জীবন বীমায় কিস্তি নির্দ্ধারণ” বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ।
Table of Contents
কিস্তি নির্ধারণের পদ্ধতি বা উপায়সমূহ
জীবন বীমায় কিস্তি নির্ধারণ তথা হিসেবকরণ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা, সঠিকভাবে কিস্তি নির্ধারণের উপরই বীমা প্রতিষ্ঠানের সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করে। কিন্তু, এই কিস্তি নির্ধারণ কাজটি বেশ জটিল। কেননা, এর সাথে জড়িত রয়েছে অনেক বিষয়। যেমন: বীমাপত্রটি কোন ধরনের, তার মেয়াদ কি রকম, প্রস্তাবিত সুবিধাদি কি কি ইত্যাদি। যাই হোক, আনুষঙ্গিক বিষয়াদি বিবেচনা সাপেক্ষে নিম্নোক্ত কয়েকটি পন্থায় জীবন বীমার কিস্তি নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।
১। নির্ণয়ন বা নিরূপণ পরিকল্পনা বা পদ্ধতি (Assessment plan or system) :
বীমা কিস্তি নির্ধারণের তথা হিসেব করার জন্যে এ পদ্ধতিটিই সবচেয়ে প্রাচীন। এ পদ্ধতিটি বীমা ব্যবস্থা উদ্ভবের একটি পন্থাও বটে। কেননা, তখন আধুনিক বীমা ব্যবস্থা ছিলনা। মৃত্যুজনিত অথবা মানুষের জীবনের উপর সঙ্ঘটিত দুর্ঘটনাজনিত কোন আর্থিক ক্ষতি বা অসুবিধা কাটিয়ে ওঠার পারস্পরিক স্বার্থে কতিপয় লোক একত্রিত হয়ে কোন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলত যা Mutual Association(পারস্পরিক সমিতি) অথবা Mutual Assurance Co. (পারস্পরিক বীমা কোং) নামে অভিহিত হতো।
এ ধরনের সংঘবদ্ধ একদল মানুষের মধ্য থেকে কেউ মারা গেলে তখন মৃত ব্যক্তির পোষ্যদের তথা পরিবার রক্ষার স্বার্থে সমিতিবন্ধ অন্যান্য ব্যক্তিগণ সবাই মিলে কি পরিমাণ অর্থ প্রদান করা প্রয়োজন তা হিসেব বা নির্ধারণ করতেন। তারপর সেই অর্থ প্রদানের জন্যে সবাই মিলে সম পরিমাণে কিস্তি প্রদান করতেন। সবাই মিলে অর্থের পরিমাণ নির্ধারণ এবং প্রত্যেকের কিস্তি নির্ণয় করতেন বলে এই পদ্ধতিকে নির্ণয়ন বা নিরূপণ পদ্ধতি নামে অভিহিত করা হয়।
স্বভাবতঃই এ পদ্ধতির কতিপয় সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি ছিল। যথা : –
(ক) মৃত্যু সংখ্যার উপর প্রিমিয়াম প্রদেয় হতো বলে কতবার প্রিমিয়াম দিতে হবে তা পূর্বে ধারণা করা যেত না এবং এটি একটি অনির্ধারিত বোঝা বলে মনে হতো;
(খ) বয়স, আয় ইত্যাদির কথা বিবেচনা না করে সকলের উপর সমহারে কিত্তি ধার্যকরা হতো বলে তা অসামঞ্জস্যপূর্ণ হতো এবং
(গ) অনেক সময় যুবক সদস্যরা বয়স্ক ও বৃদ্ধদের উপর বোঝা চাপিয়ে সমিতি ত্যাগ করত।
স্বাভাবিক কারণেই এটি ছিল একটি অতন্ত মামুলী ও ত্রুটি পূর্ন ব্যবস্থা। ফলে, উন্নত পদ্ধতি প্রবর্তনের প্রচেষ্টা চলতে থাকে।
২। স্বাভাবিক কিস্তি পরিকল্পনা (Natural Premium Plan):
নির্ণয়ন পদ্ধতির অসুবিধাগুলি দূর করার চেষ্টা থেকেই প্রকৃতপক্ষে স্বাভাবিক কিস্তি পরিকল্পনার উদ্ভব ঘটে। নির্ণয়ন পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা দূরীকরণের লক্ষেই এ পদ্ধতিতে মৃত্যুহার পঞ্জি থেকে প্রাপ্ত মৃত্যুহারের উপর নির্ভর করে কিস্তি নির্ধারণ বা হিসেব করা হয়। আবার, নির্ধারিত বার্ষিক কিস্তি বছরের শুরুতেই আদায় করা হয়। দ্বিতীয়তঃ এ পদ্ধতিতে চুক্তি প্রবেশকালীন বয়স-এর উপর নির্ভর করে বীমা কিস্তি হয় যথার্থ। যেমনঃ ৩০ বছর বয়স্ক কোন বীমাগ্রহীতার ৫০ বছর বয়স্ক বীমাগ্রহীতাকে অধিক বীমাকিস্তি প্রদান করতে হয়। কেননা, তার মৃত্যুর সম্ভাবনা পূর্বোক্ত বীমাগ্রহীতার চেয়ে বেশী থাকে।
এইপরিকল্পনার আর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে এখানে বীমাগ্রহীতার বয়স বাড়ার সাথে সাথে কিত্তিও বাড়তি হারে নির্ধারিত ও আদায়কৃত হয়। কেননা, জীবনের একটি পর্যায় থেকে বয়স বাড়ার সাথে মৃত্যুর সম্ভাবনা ও ঝুঁকি বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয় এবং সেই সাথে বাড়তি হারে কিস্তি আদায় করা হয় বলে একে স্বাভাবিক কিস্তি পরিকল্পনা বা পদ্ধতি বলা হয়। এ পদ্ধতিতে নিম্নে বর্ণিত সুত্র অনুসারে কিন্তুি নির্ণয় করা হয় –
স্বাভাবিক কিস্তি = মৃত্যুর সংখ্যা*বীমাকৃত অর্থ/ জীবিত বীমাগ্রহীতার সংখ্যা এ পরিকল্পনায় প্রত্যেক বছর বীমা কিস্তির হার বৃদ্ধি হয় এবং ফলে নতু হারে কিস্তি দিতে হয় বলে একে বার্ষিক নবায়ন যোগ্য সাময়িক পরিকল্পনা (Yearly Renewable Term plan) বলা হয়। কিন্তু, এ পদ্ধতিরও বেশ কিছু ত্রুটি রয়েছে যার জন্যে এ পদ্ধতিও ক্রমাগতভাবে জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে।
এ পদ্ধতির যেসব ত্রুটি বা অসুবিধা রয়েছে তা সংক্ষেপে নিম্নরূপ :
(ক) এ পরিকল্পনায় বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রিমিয়াম বৃদ্ধি পেতে থাকে। অথচ, বীমাগ্রহীতার রোজগারের বৃদ্ধির চেয়ে বেশী দ্রুত গতিতে খরচ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং এক সময় রোজগারই কমে যায়। তা সত্ত্বেও তাকে প্রবর্ধিত হারে কিস্তি দিতে হয় যা অত্যন্ত অসুবিধাজক ।
(খ) প্রত্যেক বছর নতুন নতুন হারে কিস্তি আদায় করা হয় বলে তার হিসেব করা জটিল ও দুরুহ হয়ে পড়ে। (গ) প্রতিবছর নতুন নতুন আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয় বলে অনেক বীমাগ্রহীতাই অসময়ে অযোগ্য বিবেচিত হওয়ায় বীমার ফল ভোগ করতে পারেন না এবং
(ঘ) প্রতিবছর বীমাদাবী পরিশোধ করতেই কিস্তির অর্থ শেষ হয়ে যায় বিধায় কোন উদ্বৃত্ত থাকে না।
৩। সম-কিস্তি পরিকল্পনা (Level Premium Plan) :
স্বাভাবিক কিস্তি পরিকল্পনার অসুবিধাসমূহ দূরীকরণের প্রচেষ্টা থেকে আর একটি পদ্ধতি বা পরিকল্পনার উদ্ভব ঘটে যা সম-কিস্তি পরিকল্পনা নামে অভিহিত হয়। স্বাভাবিক কিস্তি পদ্ধতির প্রধান অসুবিধা হলো – ক্রমাগতভাবে বর্ধিত হারে কিস্তি প্রদান কর; এ অসুবিধা দূরীকরণার্থে সম-কিস্তির চিন্তা এসেছে। আর, তার ফলে সম-কিস্তি পরিকল্পনায় কোন বীমাগ্রহীতা কর্তৃক প্রদেয় সকল কিস্তিই হয় সম-পরিমানের। কিস্তি বর্ষিক, যাম্মাসিক, ত্রৈ-মাসিক বা মাসিক কিস্তিই হবে সমান। যাই হোক না কেন, প্রদেয় সব
এ পরিকল্পনায় প্রথম থে—ে শেষ অবধি একই পরিমানের কিস্তি আদায় করে বিধায় প্রথম দিকে বীমাগ্রহীতার কাছ থেকে বীমাখরচের তুলনায় বেশী পাওয়া যায় (অর্থাৎ, বীমা কোম্পানীকে সংশ্লিষ্ট বীমাগ্রহীতা শ্রেণীর জন্যে প্রদেয় বীমাকিস্তি ও বীমা খরচ বাবদ পরিশোধের তুলনায় সংশ্লিষ্ট গ্রুপের বীমাগ্রহীতাদের কাছ থেকে বীমাকারী বেশী পেয়ে থাকেন)। ফলে, পরবর্তীতে যখন খরচ বাড়ে তখন প্রথমদিকে প্রাপ্ত সেলামীর আধিক্য থাকে তা পুরণ করা হয়। এতে বীমা তহবিলের টাকা অহেতুক অলসভাবে পড়ে থাকে না।
অপরদিকে, এ পদ্ধতিতে সব সময়ই সমান কিস্তি দিতে হয় বলে বীমাগ্রহীতারও কোন অসুবিধা হয় না। কারণ, প্রথমদিকে বীমাগ্রহীতার রোজগার কম হলেও খরচও কম থাকে এবং পরবর্তী সময়ে রোজগার বাড়লেও খরচও বাড়ে। ফলে, বীমাগ্রহীতার জন্যে সমকিস্তি পরিকল্পনাই সমধিক গ্রহণযোগ্য হয়। কেননা, তার আয় ব্যায়ের ভারসাম্য রক্ষায় এ ধরনের পরিকল্পনাই সুবিধাজনক হয়। এছাড়া, সমকিস্তি বীমা পরিকল্পনায় বীমাকারীর হিসেব-নিকাশ করায়ও সুবিধা হয়।
এসব কারণেই আজকাল অধিকাংশ বীমাপ্রতিষ্ঠানই সম-কিস্তি পরিকল্পনা বা পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে।
আরও পড়ুনঃ