জীবন বীমায় প্রিমিয়ামের হার নিয়ন্ত্রণকারী শর্ত বা উপাদানসমূহ – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “বীমা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা” বিষয়ের “জীবন বীমায় কিস্তি নির্দ্ধারণ” বিভাগের একটি পাঠ। জীবন বীমায় কিস্তি নির্দ্ধারণ, জীবন বীমার ক্ষেত্রে কি পরিমান বীমাকৃত অর্থের জন্যে কত সংখ্যক কিস্তি প্রদেয় এবং প্রতিটি বীমা কিস্তির হার কত হবে তা যথার্থভাবে নির্ধারিত না হলে বীমাকারীর এমনকি, বীমাগ্রহীতারও অসুবিধা দেখা দিতে পারে। বিশেষতঃ আধুনিক প্রতিযোগিতা পূর্ণ বীমা ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে তা একান্তই অপরিহার্য।
অন্যথায়, বিফলতা হয় অবধারিত। তাই বীমা প্রতিষ্ঠানসমূহ বিশেষজ্ঞদের দ্বারা প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে কতকগুলি অপরিহার্য শর্ত বা উপাদানের উপর বিচার বিশ্লেষণ করে বীমার প্রিমিয়াম নির্ধারণ করে থাকে। বীমা বিশারদগণ বীমা কিস্তি নির্ধারণের ক্ষেত্রে যেসব বিষয়কে নিয়ন্ত্রনকারী শর্ত বা উপাদান হিসেবে বিবেচনা বা গণ্য করেন, সেগুলি সম্পর্কে নিম্নে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা প্রদান করা হলো :-
Table of Contents
জীবন বীমায় প্রিমিয়ামের হার নিয়ন্ত্রণকারী শর্ত বা উপাদানসমূহ
১। প্রস্তাবিত বীমাদাবী বা বীমাকৃত অর্থ অথবা বীমাপত্রের মূল্য Proposed claim or insured amount or insured value):
বীমা বিশারদগণ বীমাকিত্তি নির্ধারণের ক্ষেত্রে সর্বাগ্রেই বিবেচনা করেন বীমাপত্রের মূল্য কত বা বীমাদাবী কত হতে হবে। বীমাপত্রের মূল্য বা বীমাদারী বেশী হলে বীমাকিস্তির পরিমাণ বেশী হবে; আর, দাবী কম হলে কিস্তির পরিমাণ কম হবে – সঙ্গত করণেই।
২। বীমাচুক্তির ধরন (Type of insurance contract) :
জীবনবীমা চুক্তি বিভিন্ন ধরণের হতে পারে বিধায় বীমা কিত্তিও স্বাভাবিক কারণে বিভিন্ন পরিমানের হয়ে থাকে। অর্থাৎ, বীমা চুক্তির ধরনও বীমাকিস্তি নির্ধারণের জন্যে অপরিহার্য শর্ত।
৩। প্রিমিয়াম বা কিস্তির ধরন (Type of premium) :
প্রিমিয়ামেরও শ্রেণী বিভাগ রয়েছে এবং তা বিভিন্ন মেয়াদাস্তে পরিশোধ্য হতে পারে। তাই, প্রিমিয়ামেরও মেয়াদ অনুযায়ী পরিমাণ নির্ধারিত হয়ে থাকে।
৪। ব্যবস্থাপনা খরচ (Expenses or cost of management) :
বীমা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কার্যাবলীর জন্যে খরচ হয়ে থাকে। সুতরাং, ব্যবস্থাপনার খরচের পরিমানের উপর বীমা কিস্তি নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে।
৫। বিনিয়োগের উপর প্রাপ্য সুদ (Interest receivable on invesment) :
বীমা প্রতিষ্ঠানসমূহ বীমাগ্রহীতাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত কিস্তির অর্থ আবার বিভিন্ন আর্থিক সংস্থায় বিনিয়োগ করে সুদ পায়। উক্ত সুদের হারও কিস্তি নির্ধারণ বা নিয়ন্ত্রণের একটি অন্যতম উপাদান। কেননা, সুদ বেশী হলে বীমা প্রতিষ্ঠান একটু কম কিস্তি নিয়েও ব্যবসায় চালাতে পারে।
৬। ঝুঁকির প্রকৃতি ও পরিমাণ (Nature & amount of risk) :
বীমা কিস্তি নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে ঝুঁকি। প্রস্তাবিত বীমা চুক্তিতে ঝুঁকির ধরনই বা কি এবং পরিমান কতটা তার উপর নির্ভর করেই স্বাভাবিক কারণে কিস্তি নির্ধারিত হয়ে থাকে। ঝুঁকি যদি বেশী হয় কিস্তিও বেশী হবে পরিমানে অথবা সংখ্যায়; আর ঝুঁকি কম হলে কিস্তিও কম হবে সঙ্গত কারণেই। ঝুঁকির প্রকৃতি ও পরিমাণ নির্ভর করে কতকগুলি বিষয়ের উপর সেগুলি একক অথবা সমষ্টিগতভাবে কিস্তি নির্ধারণে একান্ত বিবেচ্য তথা নিয়ন্ত্রণকারী শর্ত। নিম্নে তাদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো ;
(ক) বীমাগ্রহীতার বয়স (Age of insured) :
মানুষের জন্ম থেকে দশ বছর পর্যন্ত এবং পঞ্চাশ বছর বয়সের পরে মৃত্যুর সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত বেশী বলে উক্ত বয়ঃক্রমের আওতাধীন মানুষের জীবনের ঝুঁকি বেশী এবং প্রিমিয়ামও বেশী হয়।
(খ) বীমাগ্রহীতার পেশা (Profession of Insured) :
বিপদজনক পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তির জীবনের ঝুঁকি বেশী বিধায় প্রিমিয়ামও বেশী হয় এবং অপেক্ষাকৃত নিরাপদ পেশার তথা ১ম শ্রেণীর জীবনের ঝুঁকি কম বিধায় বীমা প্রিমিয়াম ও কম হয়ে থাকে।
(গ) বীমাগ্রহীতার দৈহিক গঠন (Build of the insured) :
বীমাগ্রহীতার শারীরিক গঠনই তার জীবনের একটি ঝুঁকি নির্দেশক বিধায় প্রিমিয়ামেরও নিয়ন্ত্রণকারী শর্ত। শারীরিক গঠন অসামঞ্জস্যপূর্ণ হলে তা রোগ ব্যাধির লক্ষণ বলে বোঝা যায় এবং তা স্বভাবতঃই অধিক ঝুঁকি নির্দেশ করে।
(ঘ) বীমাগ্রহীতার স্বাস্থ্যগত অবস্থা (Physical Condition) :
বীমাপত্রধারীর স্বাস্থ্যগত অবস্থা খারাপ থাকলে বা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে থাকলে অনেক সময় বীমাকারী অবস্থা ভেদে চুক্তিতে নাও আসতে পারেন – আসলেও ঝুঁকি বেশী থাকে বিধায় প্রিমিয়াম বেশী ধার্য করেন। আর, স্বাস্থ্য ভাল থাকলে ঝুঁকিও কম থাকে এবং কিস্তিও কম হয়ে থাকে।
(ঙ) বীমাগ্রহীতার ব্যক্তিগত বিবরণ (Personal history of the insured) :
বীমাগ্রহীতার ব্যক্তিগত বিবরণের মধ্যে তার স্বাস্থ্যগত ইতিবৃত্ত (Health Record), অতীত অভ্যাস, পূর্বাপর কাজকর্ম ও পেশার বিবরণ, বীমা করার ইতিবৃত্ত ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে। এসব বিষয়ে বীমাগ্রহীতার ভালমন্দের উপর ঝুঁকিও কম-বেশী হয় এবং কিস্তিও সে মতে নিয়ন্ত্রিত হয়।
(চ) বীমাগ্রহীতার পারিবারিক ইতিহাস (Family history) :
বীমাগৃহীতার পরিবারে কারও দূরারোগ্য সংক্রামক ব্যাধি থাকলে, কোন খারাপ অভ্যাস থাকলে অথবা পারিবারিক পেশাই যদি স্বাস্থ্যের প্রতি ক্ষতিকারক হয় তাহলে স্বভাবতঃই সে পরিবারের ইতিহাস বীমাকারীর জন্যে অনুকূল নয় বিধায় এ ধরনের পরিবারের কোন সদস্যের সাথে বীমাকারী চুক্তিতে নাও আসতেপারেন এবং আসলেও বেশী ঝুঁকি বিদ্যমান থাকায় বেশী প্রিমিয়াম ধার্য করে থাকেন। পক্ষান্তরে, অনুকূল পারিবারিক ইতিহাস কম প্রিমিয়ামে চুক্তিবদ্ধ হতে উৎসাহিত করবে।
(ছ) বীমাগ্রহীতার আবাস (Residence) :
বীমাগ্রহীতা ভাল আবাসিক এলাকায় বসবাস করলে তার জীবন কম ঝুঁক সম্পন্ন হবে এবং নোংরা ও খারাপ এলাকায় আবাস থাকলে জীবনের ঝুঁকও যেমন বেশী থাকে, তার জন্যে বীমা প্রিমিয়ামও তেমনি বেশী হয়ে থাকে।
(জ) বীমাগ্রহীতার নৈতিকতা ও বর্তমান অড্যাস (Morality & present habit) :
বীমাগ্রহীতার বর্তমান অভ্যাস এবং নৈতিকতা ঝুঁকি নিরূপণে যেমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তেমনি প্রিমিয়াম নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণেও অন্যতম শর্ত হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে।
এ ছাড়া আরও কিছু বিষয় রয়েছে। তবে, মোটামুটিভাবে উল্লিখিত বিষয়সমূহই ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে অপরিহার্য শর্ত বা উপাদান হিসেবে পরিগণিত ও বিবেচিত হয়ে থাকে।
আরও পড়ুনঃ