জীবন বীমা চুক্তির বৈশিষ্ট্যসমূহ – পাঠটি “বীমা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা” বিষয়ের “জীবন বীমা” অধ্যায়ের একটি পাঠ। এটি একটি স্বীকৃত সত্য যে – প্রায় প্রতিটি বিষয় বা বস্তুর নিজস্ব কিছু না কিছু স্বতন্ত্রতা বা বিশিষ্টতা অথবা বৈশিষ্ট্য থাকে। যে কোন চুক্তিরও তাই কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে—বীমা চুক্তিরতো বটেই (যেমনঃ প্রতিটি চুক্তিতে কমপক্ষে দু’টো পক্ষ থাকতে হয়, সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহকে কিছু পূর্বাপর আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয়, চুক্তি গঠন ও সম্পাদনের কিছু সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া থাকে ইত্যাদি)।
জীবন বামা চুক্তির ক্ষেত্রেও সে একই দৃষ্টিকোন থেকে লক্ষ্য করলে কতিপয় বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হবে। অর্থাৎ, অন্যান্য চুক্তি বা প্রায় সমজাতীয় বিষয়ের সাথে এর যেসব বিশিষ্টতা বা স্বাতন্ত্র্য রয়েছে, সেগুলোই এখানে প্রতিপাদ্য। অপরিহার্য উপাদানের সাথে বিশিষ্টতা বা বৈশিষ্ট্যের এখানেই পার্থক্য (জীবন বীমা চুক্তির অপরিহার্য উপাদানসমূহ সম্পর্কে অব্যবহিত পরেই বর্ণনা প্রদান করা হয়েছে)। জীবন বীমার সংজ্ঞা, প্রকৃতি, আওতা, পরিধি তথা বিষয়বস্তু ইত্যাদি পর্যালোচনা করে যেসব বৈশিষ্ট্য পরিদৃষ্ট হয়, সেগুলি সম্পর্কে নিম্নে সংক্ষেপে বর্ণনা প্রদান করা হলোঃ –
Table of Contents
জীবন বীমা চুক্তির বৈশিষ্ট্যসমূহ
১। আনুষ্ঠানিক তথা বিশিষ্ট চুক্তি ( Formal as well as specialty contract):-
চুক্তি সচরাচর তিন ধরনের হতে পারে। যথাঃ – (1) সাধারণ চুক্তি (General Contract), (২) বিশিষ্ট চুক্তি | Specialty Contract) ও (৩) তালিকা বা নিবন্ধভুক্ত চুক্তি (Contracts of Record)। জীবন বীমা চুক্তি বৈশিষ্ট্যগত কারণেই আনুষ্ঠানিক চুক্তি। আর, বিশিষ্ট চুক্তি মূলতঃ আনুষ্ঠানিক। আনুষ্ঠানিক চুক্তির আনুষ্ঠানিকতা হলো এই যে, এধরনের চুক্তি হবে—
(ক) লিখিত,
(খ) সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহ কর্তৃক যথারীতি স্বাক্ষরকৃত,
(গ) প্রয়োজনে যথারীতি সীল প্রদত্ত,
(ঘ) প্রয়োজনে ষ্ট্যাম্প প্রদত্ত,
(ঙ) প্রয়োজনে অথবা রীতিগতভাবে নিবন্ধিত এবং
(চ) হস্তাস্তর সাপেক্ষ।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে – প্রতিদান ছাড়া চুক্তিই সাধারণতঃ আনুষ্ঠানিক হয়ে থাকে। কিন্তু, বীমা চুক্তি প্রতিদান থাকা সত্বেও আনুষ্ঠানিক হওয়া অত্যাবশ্যকীয়। তাই, জীবন বীমার চুক্তি আনুষ্ঠানিক এবং কখনও বা কিয়দংশে হলেও বিশিষ্ট চুক্তি।

২। বিষয় বস্তু (Subject matter):
জীবন বীমা চুক্তির বিষয়বস্তু স্বভাবতঃই জীবন, হতে পারে তা নিজের বা নিজেদের এবং অন্যের বা অন্যদের (বীমাযোগ্য স্বার্থ বিদ্যমান থাকলে)।
৩। উদ্দেশ্য (Objective) :
অন্যান্য বীমাচুক্তি মূলতঃ আর্থিক ক্ষতির অনিশ্চয়তা তথা ঝুঁকির বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যে গঠিত হয়। কিন্তু, জীবন বীমা চুক্তি একাধারে দু’টি উদ্দেশ্যে গঠিত হয়ে থাকে। যথাঃ –
(ক) জীবন বীমা চুক্তি জীবনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান আর্থিক ক্ষতির অনিশ্চয়তা বা ঝুঁকির বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতিতে গঠিত হয় এবং
(খ) জীবন বীমা চুক্তিতে বীমাকৃত ব্যক্তি বা বীমাগ্রহীতাকে সাধারণতঃ নির্দিষ্ট মেয়াদ পরপর নির্দিষ্ট পরিমাণের প্রিমিয়াম বা সেলামী দিয়ে যেতে হয় যার জন্যে তাকে সঞ্চয় করতে হয়। প্রতিদানে বীমাকারী বীমাকৃত ব্যক্তি বা বীমাগ্রহীতার জীবদ্দশায় এবং/অথবা মৃত্যুতে সুদে-আসলে মিলিয়ে বীমাদাবী পরিশোধ করে থাকেন। সুতরাং, উক্ত প্রদত্ত সেলামী বিনিয়োগ হিসেবে কাজ করে।
৪। চূড়ান্ত সদ্বিশ্বাসের চুক্তি (Contract of utmost good faith) :
অনেক চুক্তি আছে যা চূড়ান্ত সদ্বিশ্বাসের চুক্তি নয়। যেমনঃ – একটি সাধারণ ক্রয়-বিক্রয়ের চুক্তি। কিন্তু, জীবনবীমা চুক্তি চূড়ান্ত সদ্বিশ্বাসের চুক্তি। কেননা, বীমা চুক্তি গঠনের জন্যে সরবরাহকৃত প্রস্তাবনা পত্রে (Proposal Form) সামান্যতম মিথ্যা বিবৃতি দেয়া হলে অথবা সংশ্লিষ্ট যে কোন পক্ষ বিশ্বাস ভঙ্গ হতে পারে অথবা অপরপক্ষের ক্ষতি হতে পারে – এরূপ অসত্য বিবৃতি প্রদান করলে জীবন-বীমা চুক্তি বাতিল হয়ে যায়।
৫। প্রস্তাবের স্বীকৃতি (Acceptance of the offer) :
অন্যান্য চুক্তির চেয়ে জীবন-বীমা চুক্তির ক্ষেত্রে প্রস্তাবের স্বীকৃতি অধিক নিয়ন্ত্রিত ও কঠিন। কেননা, এক্ষেত্রে বীমা কোম্পানী কর্তৃক মুদ্রিত নির্দিষ্ট প্রস্তাবনা পত্র (Proposal Form) প্রদান করা হয় যার কোন ধরনের পরিবর্তন, সংযোজন, বিয়োজন ইত্যাদি সাপেক্ষে স্বীকৃতি প্রদানের প্রচেষ্টা প্রারম্ভেই (ab initio) স্বতঃনিষিদ্ধ বলে পরিগণিত হয়। এজন্যেই জীবন-বীমা চুক্তিকে প্রস্তাব বা শর্তানুগ চুক্তি (Contract of adhesion) বলে।
৬। দাবীর পরিমাণ (Amonut of claim) :
অন্যান্য চুক্তির ক্ষেত্রে সাধারণতঃ প্রতিবাদ বা দাবী হয় সমপরিমাণের। তাই, সেসব চুক্তিকে পরিবর্ত চুক্তি (Commutative Contract) বলে। কিন্তু, জীবন-বীমা চুক্তিতে সাধারণতঃ তা হয় না। কোন ক্ষেত্রে সেলামী হিসেবে প্রদত্ত অর্থের বেশী পাওয়া যায় এবং কখনও সেলামীর বিনিময়ে বীমাদাবী পাওয়া যায়, কখনও আবার কিছু পাওয়াই যায় না। তাই, এরূপ বীমা চুক্তিকে অনিশ্চয়তা বা দৈব-নির্ভর চুক্তি (Aleatory Contract) বলা হয়।
৭। মনোনয়ন (Nomination) :
জীবন-বীমার ক্ষেত্রে বীমাগ্রহীতা বীমাচুক্তি গঠনের সময় বা তার মৃত্যুর আগে অথবা বীমাদাবী উপস্থাপন করার আগে যথাসময়ে নিকটতম আত্মীয়-স্বজনকে বীমাদাবীর অর্থ গ্রহণের জন্যে মনোনীত করে দিতে পারেন।
৮। অধিকারার্পণ বা হস্তান্তর (Assignment) :
কেবল জীবন-বীমার ক্ষেত্রেই বীমাযোগ্য স্বার্থ থাক বা না থাক – বীমাপত্র অন্যকে বৈধ প্রতিদানের – বিনিময়ে বা স্নেহ-মমতার সম্পর্কের কারণে হস্তান্তর করা বা বীমাপত্রের অধিকার অর্পন করা যায়। অর্থাৎ, জীবন-বীমার ক্ষেত্রে বীমাপত্র সহজেই হস্তান্তরযোগ্য যা অন্যান্য চুক্তির ক্ষেত্রে তেমন সম্ভব নয়।
৯। একতরফা চুক্তি (One-sided contract) :
জীবন-বীমা চুক্তিতে যখন যে পক্ষ কর্তব্য পালন করেন, সে পক্ষই পালন করতে থাকেন। বীমাগ্রহীতা যখন সেলামী বা প্রিমিয়াম দিতে থাকেন, বীমাকারী তখন সচরাচর কিছুই করেন না এবং সেলামী দেয়া হয়ে গেলে ভবিষ্যতের সকল কর্তব্যই রয়ে যায় বীমাকারীর উপর। তাই, বীমাচুক্তি অনেক সময় এক-তরফা চুক্তি হিসেবেই প্রতিভাত হয়।
১০। শর্তাধীন চুক্তি (Conditional contract) :
পূর্বোক্ত বর্ণনা অনুযায়ী পুনরুক্তিতে বলা যায় যে—জীবন-বীমা চুক্তিতে প্রিমিয়াম দেয়া হয়ে গেলেও সংশ্লিষ্ট পক্ষকে পরবর্তী কতকগুলি চুক্তি-নির্ধারিত শর্ত পালন করতে হয়। অর্থাৎ, বীমাদাবী পূরণ করার জন্যে প্রয়োজনীয় ও নির্ধারিত শর্তসমূহ পালন করতে হয়। তাই একে শর্তাধীন চুক্তি বলা হয়।
১১। সামগ্রিকভাবে সম্পাদ্য চুক্তি ( Conract to be executed wholly) :
জীবন-বীমা চুক্তির আংশিক পালন বা আংশিক কিত্তি ফেরত হয় না। বীমাকারী যদি ঝুঁকি গ্রহণ করেন, তাহলে আর কোন কিস্তি বা আংশিক সেলামীর ফেরতদানের কোন অবকাশ থাকে না। তবে, বীমাকারী যদি ঝুঁকি গ্রহণ না করেন – সেলামী সম্পূর্ণটাই ফেরত প্রদান করে থাকেন।
এ ছাড়াও, কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমনঃ জীবন-বীমা চুক্তি ব্যক্তিগত – চুক্তিবিশেষ, এটি উৎস সংক্রান্ত চুক্তি ইত্যাদি। তবে, মোটামুটিভাবে প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ উপরে বর্ণিত হলো।
আরও পড়ুনঃ