ঝুঁকি মূল্যায়ন (নিরূপণ)

ঝুঁকি মূল্যায়ন (নিরূপণ) – পাঠটি “বীমা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা” বিষয়ের “ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা” অধ্যায়ের একটি পাঠ। বীমা কিস্তি বা সেলামী নির্ধারণের জন্যে ঝুঁকি নির্ধারণ বা নিরূপণ করা দরকার। ঝুঁকি নির্বাচন (Selection) বা নিরূপণ (Determine) করতেই আবার ঝুঁকিকে বিভক্ত ও শ্রেণীভুক্ত করতে হয়। ঝুঁকিকে শ্রেণীবদ্ধকরণ তথা নিরূপণ বা মূল্যায়নের জন্যে দু’টি পদ্ধতি রয়েছে। যথাঃ (১) বিচার পদ্ধতি ও (২) আঙ্কিক মূল্যায়ণ পদ্ধতি। নিম্নে এ দু’টি পদ্ধতি পরীক্ষা করতে বর্ণনা প্রদান করা হলো।

ঝুঁকি মূল্যায়ন (নিরূপণ)

 

১. ঝুঁকি নিরূপণের বিচার পদ্ধতি Judgement Method of Evaluating Risk :

 এ পদ্ধতিতে বীমা প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসা, হিসাব ও দায় গ্রহণ বা বীমাকরণ বিভাগের অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তসমূহ একত্রিত করা হয়। এসব ব্যক্তিগণ প্রয়োজনীয় শিক্ষায় শিক্ষিত ও অনুমোদনপ্রাপ্ত। এ পদ্ধতিতে অন্যান্য পদ্ধতির ন্যায় ধরা বাধা নিয়ম নেই। বরং, এ ক্ষেত্রে দায়গ্রহণ বা বীমাকরণের পুরো প্রক্রিয়াতেই ব্যক্তিগত বিচার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ পদ্ধতিতে

আবেদনপত্রের আলোকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারীদের দ্বারা যথারীতি বাছাই পূর্বক প্রস্তাবগুলিকে প্রণালীবদ্ধ করা হয় এবং সন্দেহজনক বা প্রাস্তিক প্রস্তাব বা কেসসমূহ (Cases)-কে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের দ্বারা গৃহীত বা স্থিরীকৃত হয়। যেখানে একটি মাত্র বিষয় বিবেচনা করা হয় অথবা যেখানে গ্রহণ বা বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সেখানেই সাধারণতঃ বিচার পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। দ্বিতীয়তঃ যেখানে আকিক মূল্যায়ণ পদ্ধতি অকার্যকর হয়, সেক্ষেত্রে প্রতিটি বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে বিবেচনা করে সিদ্ধার্থ নিতে বিচার পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। নির্বাহী, ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সিদ্ধান্ত দ্রুততর এবং অর্থপূর্ণ হতে পারে।

কিন্তু, বিচার পদ্ধতির সুবিধাজনক দিকগুলোই মূলতঃ উপরে বলা হয়েছে । অসুবিধা বা ত্রুটির দিকে আলোকপাত করা হয়নি। এ পদ্ধতির বেশ কিছু অসুবিধাজ রয়েছে যা সংক্ষেপে নিম্নে বর্ণিত হলো : –

(১) বিচার পদ্ধতিতে নির্বাহী বা কর্মকর্তাদের একগুয়েমী বা অবহেলাজনিত কারণে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত ও নির্দেশাবলী ত্রুটিযুক্ত বা পারে। একদেশদর্শীতাপুষ্ট ।

(২) অনভিজ্ঞতাজনিত সিদ্ধান্ত ক্ষতিকারক হতে পারে এবং (৩) এ পদ্ধতি তেমন বিজ্ঞানভিত্তিক নয়। কেননা, এ পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত নেয়ার ‘ জন্যে একমাত্র ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ছাড়া অন্য কোন ভিত্তি নেই।

তাই, ঝুঁকি নিরূপণে বিচার পদ্ধতির ত্রুটিগুলো এড়ানোর জন্যে আধুনিক কালে অধিকাংশ বীমাকারীই আকিক মূল্যায়ন পদ্ধতি অনুসরণ ও ব্যবহার করে থাকেন।

 

insurancegoln Google news
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

২. ঝুঁকি নিরূপণের আঙ্কিক মূল্যায়ন পদ্ধতি (Numerical Rating System of Evaluating Risk) : 

একটি ঝুঁকি মিশ্রণে (Composition of risk) বা গঠনে বেশ কিছু সংখ্যক উপাদান থাকতে পারে এবং সে উপাদানসমূহ বিদ্যমান রয়েছে এমন সব জীবনের উপর পরিসংখ্যানগত বিচার বিশ্লেষণ দ্বারা ঝুঁকির স্থায়ীত্বের উপর উক্ত প্রতিটি উপাদানের প্রভাব নির্ভারণ করা যেতে পারে। এ নীতির উপর ভিত্তি করেই ঝুঁকি নিরূপণে আঙ্কিক মূল্যায়ন পদ্ধতি সৃষ্টি হয়েছে। এ পদ্ধতিতে ঝুঁকি নিরূপণ করতে প্রতিটি উপাদানের স্বাভাবিক মান করে নেয়া হয় ১০০।

অর্থাৎ, যে উপাদানটির মান ১০০ সেটিকে আর কোন নম্বর বন্টন করা হয় না। এভাবে একটির পর একটি উপাদানকে বিচার-বিবেচনা করা হয়। ঝুঁকির অনুকূলে উপাদানসমূহকে না বাচক নম্বর বন্টন করা হয় যাকে বলা হয় ক্রেডিট বা আকলন মূল্য (Credit values) এবং প্রতিকূল (Unfavourable) উপাদানসমুহকে হ্যাঁ বাচক নম্বর বন্টন করা হয় যাকে ডেবিট বা বিকলন মূল্য (Debits or Debit values) বলা হয়। ডেবিট ও ক্রেডিটের বীজ গাণিতিক হিসেব বা সমষ্টিকরণ (Algebraic Summation)-এর ফলাফল নির্ধারিত মান ১০০-এর সাথে যুক্ত হয় যা ঝুঁকির আকিক মূল্য নির্দেশ করে।

দৈহিক গঠন, স্বাস্থ্যগত অবস্থা, ব্যক্তিগত ইতিবৃত্ত, পারিবারিক ইতিবৃত্ত, পেশা, আবাস, অভ্যাস, নৈতিক চরিত্র এবং বীমা পরিকল্পনার ন্যায় কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবিকভাবে উপাদানের উপর মূল্য রচিত হয়ে থাকে। বীমাগ্রহীতাদের মৃত্যুহারের পরিপ্রেক্ষিতে এবং বিভিন্ন উপাদানের ভিত্তিতে শতকরা হারে ঝুঁকির মাত্রা নিরূপিত হয়ে থাকে। যদি তা ১০০-এর বেশী ২ – অর্থাৎ, ঝুঁকি যদি মানের চেয়ে বেশী হয় তাহলে অতিরিক্ত হার ডেবিট (+) করা হয় এবং ঝুঁকির মাত্রা যদি মানের চেয়ে কম তাহলে সে কম হারকে ক্রেডিট (-) করা হয়।

একটি উদাহরণের সাহায্যে আৰ্কিক মূল্যায়ন পদ্ধতিটিকে স্পষ্টতর করার চেষ্টা করা হলো। জনৈক বিবাহিত লোকের দু’টি শিশুপুত্র রয়েছে যাদের স্বাস্থ্যগত অবস্থা ভালো। লোকটির ওজন স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে শতকরা ভাগ বেশী। তার বুকের প্রশস্ততার পরিমাপ উদরের পরিধির মাপের তুলনায় এক ইঞ্চি কম। তার আয়ুস্কালের উপর কোন প্রতিকূল বা বিপরীত ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। তার পরিবার যক্ষা, উন্মাদগ্রস্ততা ইত্যাদি থেকে মুক্ত ছিল। তিনি কারুশিল্পের কাজ করতেন। তার অভ্যাস ও নৈতিক চরিত্র ভাল। তিনি একটি ভালো পরিবেশে উৎকৃষ্ট বাড়ীতে বসবাস করতেন। তিনি ২০ বছর মেয়াদী বীমা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন।

নিম্নে প্রদত্ত ছকে তাকে মাত্রাতিরিক্ত ওজনের জন্যে ডেবিট পাশে ৬০ নম্বর প্রদত্ত হয়েছে। অসামঞ্জস্যপূর্ণ দৈহিক গঠন (উদরের ঘেরের চেয়ে বুকের প্রশস্ততা কম)-এর জন্যে আরও ১০ নম্বর বেশী ডেবিট (+) পাশে দেয়া হয়েছে। তার অনুকূল পারিবারিক ইতিবৃত্তের জন্যে ক্রেডিট (—) পাশে ১৫ নম্বর প্রদত্ত হয়েছে। ২০ বছর মেয়াদী বীমা পত্রের জন্যে তাকে আরও ১০ নম্বর ক্রেডিট পাশে বন্টন করা হয়েছে। আবাস, অভ্যাস, ভাল আচরণ, পেশা ও স্বাস্থ্যগত অবস্থার জন্যে কোন নম্বর বরাদ্দ করা হয়নি।

 

ঝুঁকি মূল্যায়ন (নিরূপণ) | ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা | বীমা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা

ঝুঁকি মূল্যায়ন (নিরূপণ) | ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা | বীমা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা

 

ছক ৫২ : ঝুঁকি নিরূপণ (মান বন্টন ও বিভাগকরণ)। (Evaluation of Risk (Distribution of Marks and is Classifi cation)

 

উল্লেখ্য যে, বীমাগ্রহীতা বিশেষে মূল্যায়নের মাত্রা কম-বেশী বা ভিন্ন হতে পারে।

ঝুঁকি নিরূপণের আঙ্কিক মূল্যায়ন পদ্ধতির বিচার পদ্ধতি থেকে মূল পার্থক্য এই যে, এখানে নম্বর বন্টন করা হয়। সুর্তব্য যে, এখানেও একই উপাদানসমূহকে বিবেচনাধীনে এনে ঝুঁকির বিভিন্ন অনুকূল ও প্রতিকূল সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আর, এ পদ্ধতির কতগুলি সুবিধা রয়েছে যা বিচার পদ্ধতির নেই। যেমনঃ –

  • এ পদ্ধতি উদ্দেশ্যমূলক তথা সংক্ষিপ্ত মানভিত্তিক বিধায় ঝুঁকির চূড়ান্ত

মূল্যায়নে সহায়ক হয় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে অধিকতর সঙ্গতি রক্ষায় সক্ষম। (2) এ পদ্ধতি অপেক্ষাকৃত দ্রুততায় কার্যকর এবং ঝুঁকি নির্বাচন বা নিরূপণ মিতব্যায়ীতা রক্ষণে সহায়ক।

  • এ পদ্ধতিতে চিকিৎসা ও বীমা সংক্রান্ত হিসাবের ফলাফল দৃষ্টে য অনুসন্ধান সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া এবং ঝুঁকির বীমাকরণে প্রয়োজক (Subjective) উপাদানসমূহের কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব এবং (8) এই পদ্ধতিতেই বীমার ক্রমোন্নয়নের সাথে অবিরাম বিবেচনা ও মূল্যানে সম্ভব।

তবে, এ পদ্ধতির আবার কতকগুলি ত্রুটির দিকও অনেকে তুলে ধরেছেন। এ পদ্ধতির যেসব সমালোচনা এ পর্যন্ত লক্ষ্য করা যায়, তা সংক্ষেপে নিম্নে বর্ণিত হলোঃ-

এ পদ্ধতিটিকে অনেক বেশী বিচার সাপেক্ষ ও জটিলতাপূর্ণ মনে করা হয়;আকিক মূল্যমানসমূহ বন্টনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের জ্ঞান প্রায়শঃই অত্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে বিধায় এ পদ্ধতিতে বেশ ত্রুটি থেকে যায়। (2)

  •  পরস্পর সমবৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও অনেক উপাদান পরস্পর যুক্ত হয় না। (Non–additive)
  • ঝুঁকির বিভিন্ন উপাদানের মিথষ্ক্রিয়া (Interaction) হিসেবে নিয়েই

প্রায়শঃ মূল্যায়নের সংশোধন করা হয়।

এ পদ্ধতির সমর্থকগণ এর ত্রুটিগুলি জেনেও মনে করেন যে, কিছু কিছু ত্রুটি থাকা সত্বেও এপদ্ধতি এখনও অন্য পদ্ধতির চেয়ে শ্রেয়তর। আঙ্কিক মূল্যায়নকে পথ নির্দেশক হিসেবে গণ্য করা যায় মাত্র; ঝুঁকি নির্বাচন অনেকাংশেই নির্ভর করে চিকিৎসক, বীমা পরতালক বা হিসাব-বিশেষজ্ঞ ( Actuaries) দায়গ্রাহক ও নির্বাহীবৃন্দের ব্যক্তিগত দক্ষতা এবং বিচার-বুদ্ধির উপর।

 

আরও পড়ুনঃ

Leave a Comment