বীমার প্রকৃতি [ Nature of Insurance ] নিয়ে আজকের আলোচনা। প্রায় প্রতিটি কার্যক্রমেরই কিছু না কিছু স্বাতন্ত্র্য বা স্বকীয় বৈশিষ্ট্য থাকে। তেমন বীমার ক্ষেত্রেও রয়েছে।
Table of Contents
বীমার প্রকৃতি:
একটি কারবারী কার্যক্রম হিসেবে বীমারও তেমনি কতিপয় স্বাতন্ত্র্য তথা প্রকৃতি রয়েছে যা নিম্নে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো:
১. নিশ্চয়তা দান (Giving assurance):
জীবন-জীবিকার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে রয়েছে সীমাহীন অনিশ্চয়তা যা ব্যাখ্যা ও প্রমাণের কোন অবকাশ রাখে না। বীমা সে অনিশ্চয়তার বিরুদ্ধে যেখানে যেমন প্রয়োজন সেখানে তেমন নিশ্চয়তা প্রদানের এক বাস্তব কর্মকাণ্ড ও কার্যকর প্রক্রিয়া।
২. ঝুঁকির বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা (Protection against risk) :
জীবন যাপন এবং সম্পদ-সম্পত্তি রক্ষণ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ঝুঁকির বিরুদ্ধেই (ঝুঁকি দূরীকরণ, লাঘবকরণ ও মোকাবেলার জন্যে) যেন এক যথার্থ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে বীমা ব্যবস্থা।
৩. প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ( Preventive Measure) :
জাগতিক প্রবাহে ঝুঁকি যেমন প্রকৃতি ও পরিস্থিতিগতভাবেই বিদ্যমান রয়েছে, তেমনি জীবনপ্রবাহের স্বাভাবিক বহমানতা রক্ষার্থে কালক্রমে বীমা যেন একটি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে সৃষ্টি হয়ে ঝুঁকি মোকাবেলায় অবস্থান গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ, আর্থিক ক্ষতি যাতে না হতে পারে অথবা যদিও বা ক্ষতি অনিবার্য হয়ে পড়ে, তা যেন সর্বনিম্ন হয়; এ লক্ষ্যেও বীমা ব্যবস্থায় পন্থা নির্ধারিত ও কার্যকর হয়ে থাকে।
৪. বিপুল সংখ্যার নীতি অনুসরণ (To follow the Principle of Large Number):
বিশেষতঃ বীমাকারী নীতিগতভাবে এমন সব বিষয়ের ঝুঁকি গ্রহণ করে থাকেন যা সংখ্যায় অনেক। যেমন :– একই শ্রেণীর বা বয়ঃক্রমের মানুষ, একই ধরনের অনেক কলকারখানা, অনেক বাড়ীঘর, যানবাহন, সম্পদ সম্পত্তি ইত্যাদি। কেননা, এতে বিদ্যমান সাকল্য ঝুঁকিকে প্রস্তাবিত বা বীমাকৃত বিপুল সংখ্যক বিষয়বস্তুর মধ্যে কৌশলে বাটোয়ারা করে দেয়া যায়; এটি বীমা ব্যবস্থারই একটি স্বাভাবিক প্রকৃতি হিসেবে এখন স্বীকৃত ও পরিচিত।
৫. ঝুঁকি বন্টন ( Distribution of risk) :
কোন নির্দ্দিষ্ট বয়ঃক্রমের একটি বীমাগ্রহীতা শ্রেণী বা মানবগোষ্ঠী অথবা অনেক মানুষের একই ধরনের অনেক সম্পদ-সম্পত্তি বীমাকৃত হলে বীমাকারী নীতিগতভাবেই সংশ্লিষ্ট সকল বীমাগ্রহীতার কাছ থেকে বীমা সেলামী গ্রহণ করে থাকেন। এর অন্তর্নিহিত ও প্রকৃতিগত তাৎপর্য হচ্ছে এই যে একই জাতীয় ঝুঁকির আওতাধীন অনেক ব্যক্তি বা অনেক সম্পত্তি একই ছায়াতলে বা সমতলে আবদ্ধ হয়ে পড়ল পরস্পরে এবং বোঝা সকলের মাথায় ঠেকে গিয়ে হালকা হয়ে গেলো। অর্থাৎ, ঝুঁকি মাথায় মাথায় বন্টিত হয়ে গেলো। ঝুঁকি বন্টনের এ পদ্ধতিটি একান্তই বীমার।
৬. সমবায় পন্থা (Co-operative Device) :
বীমার জন্মলাভই হয় প্রকৃতপক্ষে সমবেত ও পারস্পরিক কল্যাণ কামনায়। ফলতঃ আজ এ আধুনিক আবয়বিক বিন্যাসেও সে সমবায়ী চেতনা ও কার্যধারা বীমা ব্যবস্থায় বিদ্যমান রয়েছে। কেননা, যে শ্রেণীর মানুষ বা সম্পদ-সম্পত্তির উপর বীমা করা হয় তার কোন একজন বা একটির ক্ষতি হলেও সকলের কাছ থেকে প্রাপ্ত সেলামীর অর্থ দিয়েই তার দারীপুরণ বা ক্ষতিপূরণ করা হয়। অর্থাৎ, একের প্রয়োজনে অন্যে এবং সকলে সামিল হন। কাজেই বীমা প্রকৃতিগতভাবেই একটি সমবায় পন্থা ও ব্যবস্থা।
৭. ঝুঁকি মূল্যায়ন ( Valuation of risk) :
যেমন দায়, তেমন -যেমন ঝুঁকি, তেমন কিস্তি বা সেলামী : এটি খুব সঙ্গত ও স্বাভাবিক একটি বায় নিয়ম। তাই, ঝুঁকি কতটা তা দেখা বীমার একটি স্বাভাবিক প্রবণতা ও প্রক্রিয়। অর্থাৎ, ঝুঁকি তথা ক্ষতির মাত্রা বুঝেই বীমা তার স্বভাবে সক্রিয় হয়; ঝুঁকি কম হলে সেলামী বা কিস্তি কম হয়। আর, ঝুঁকি বেশী হলে সেলামীও বেশী হয়ে থাকে।
৮. পরিশোধের পরিমাণ (Amount of payment):
বীমা চুক্তি যেমন বিভিন্ন রকম এবং ঝুঁকি ও ক্ষতি যেমন বিভিন্ন পরিমাণের বীমাদাবী পরিশোধের পরিমাণও তেমনি বিভিন্ন হয়ে থাকে। অর্থাৎ, ক্ষতি বেশী হলে দাবীর পরিমাণ বেশী হবে – আর ক্ষতি কম হলে দাবীও কম হবে।
৯. চুক্তিমত বা বিপদ-বিপর্যয়ে দাবী পরিশোধ (Payment at contingency):
জীবন বীমা চুক্তিতে সম্মতি মোতাবেক নির্দিষ্ট ঘটনা সংঘটনে (নির্দিষ্ট মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে অথবা বীমাকৃত ব্যক্তির মৃত্যু ঘটলে) এবং অন্যান্য বীমার ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা সংঘটিত হলেই শুধু বীমাদাবী পরিশোধ করা হয়ে থাকে। সুতরাং, জীবন বীমার অর্থ বা দাবী পরিশোধ নিশ্চিত বিধায় জীবন বীমার চুক্তি একটি নিশ্চিতির চুক্তি (a contract of certainty) — আর, অন্যান্য বীমায় দুর্ঘটনা ঘটলেই শুধু দাবী পরিশোধ করা হয় এবং অন্যথায় নয় বিধায় সম্পত্তি বীমা তথা ঐসব বীমার চুক্তি অনিশ্চিতির চুক্তি (contract of uncertainty) হিসেবে আখ্যায়িত হয়।
১০.বীমা কোন জুয়া খেলার বিষয় নয় (Insurance not a matter of gambling) :
মানুষ জীবন-জীবিকা ও সম্পদ-সম্পত্তির উপর সম্ভাব্য দুর্যোগ বা বিপদ-বিপত্তির দুর্ভাবনা থেকে অব্যাহতি লাভের আকাঙ্খায় বীমার আশ্রয় গ্রহণ করে; পক্ষান্তরে, মানুষ কখনও একান্তই সাময়িক আনন্দ লাভ বা সহজাত প্রবৃত্তি চরিতার্থ করা অথবা কোন কারণে অধিকতর অনিশ্চয়তার মধ্যে অহেতুক তৃপ্তি লাভের আকাঙ্খায় বাজি ধরা বা জুয়া খেলায় প্রবৃত্ত হয়। সুতরাং, বীমা প্রকৃতিগতভাবেই একটি বাস্তব অনুযঙ্গ এবং একটি ভিন্ন ও বৈষয়িক কর্মকাণ্ড।
১১. বীমা কোন দাতব্য বিষয় নয় ( Insurance is not a matter of charity) :
বীমা সেবাদান করে বটে; কিন্তু, বিনা প্রতিদানে সেবাদান করে না। অর্থাৎ, বীমায় সেলামীর প্রতিদানে বা বিনিময়েই শুধু দাবীপুরণ করা হয়; অন্যথায় নয়। মানব কল্যাণে স্বেচ্ছাসেবা দান বীমার কাজ নয়; বরং, বীমার সাফল্যের জন্যেই এখানে মানব কল্যাণ বা জনসেবা একটি অন্যতম উদ্দেশ্য। এটি শ্রুতিশোভন না হলেও সত্য। অর্থাৎ, বীমা প্রকৃতিগতভাবে একটি কারবার, মুনাফা অর্জন যার মূল উদ্দেশ্য।
মোটামুটিভাবে, এগুলোই হচ্ছে বীমার প্রকৃতি; তবে, স্বভাবতঃই তা আরও বিস্তৃত আলোচনার অবকাশ রাখে।
আরও পড়ুন: